প্রবন্ধ রচনা
স্বদেশ প্রেম
সংসারমঞ্চে আমরা সবাই কোনো না কোনো আকর্ষণকে কেন্দ্র করে আবর্তন করি। এ আকর্ষণেরই একটি ব্যতিক্রমী স্বাক্ষর দেশপ্রেম। ঔদার্য আর ত্যাগের মহিমায় এ ভালোবাসা প্রোজ্জ্বল। মানুষের সৃষ্টিশীল চোখে দেশপ্রেম একটু অন্য রকম ভালোবাসা, অন্য রকম আকর্ষণ। তাই কবির মনের অভিব্যক্তি—
‘স্বদেশের তরে নেই যার মন
কে বলে মানুষ তারে? পশু সেইজন।’
স্বদেশপ্রেম সবচেয়ে মহিমাময়; সর্বোচ্চ কার্যকর। স্বদেশ আমাদের মা। এর প্রতিটি ধূলিকণায় বিশ্ববিধাতার অধিষ্ঠান—এ মনোভাব হূদয় গভীরে প্রোথিত থাকলে হূদয়ের সব ভালোবাসা খুঁজে পাবে তার গন্তব্যস্থল। যে দেশে যে মানুষ জন্মগ্রহণ করে, সে দেশই তার স্বদেশ। এটি মায়ের মতোই প্রিয়, শ্রদ্ধেয়। জন্মভূমির প্রতিটি ধূলিকণাকে নিজ দেহের প্রতিটি কোষ মনে করে তাকে ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধাবোধ দেখানোই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম বা দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রীতি মানুষের ভেতর জন্ম দেয় মহৎ হওয়ার গুণাবলি। ঈশ্বরভক্তি ভিন্ন দেশপ্রীতি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম। বরফগলা পানি আর বারিধারার সম্মিলিত মিছিলে সৃষ্টি হয় নদী। এরা মাটিকে উর্বর করে শ্যামলিমাময় ধেয়ে চলে সাগরপানে। ঠিক তেমনি করে আমরাও দেশকে ভালোবেসে মানবকল্যাণে হাত বাড়িয়ে এগোতে পারি মহাশক্তি বিশ্বস্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার পথে। যিনি মা, তিনিই মাতৃভূমি, জগৎমাতা তারই মাঝে বিরাজিত। আর এ জন্যই দেশপ্রেম মহা গর্বে উচ্চকিত। তাই কবির আবেগদীপ্ত বক্তব্য, জীবন সত্যের উপস্থাপন—
‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদর্পী গরীয়সী।’
নিজের প্রতি ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয় স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা। স্বদেশের মাটি, বাতাস, পানির সঙ্গে আমরা অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। এদের সঙ্গে তৈরি হয় প্রেমের মালা। এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গহানিরই নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমের উদ্ভব হয় আত্মসম্মানবোধ থেকে। যে জাতির আত্মসম্মানবোধ যত প্রখর, সে জাতি দেশপ্রেমে তত প্রবল। দেশপ্রেম এক প্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। নিঃস্বার্থ হিংসাবিহীন স্বদেশপ্রেমই দেশপ্রেম। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থকে উপেক্ষা করে বৃহত্তর স্বার্থের দিকে মন যখন পরিচালিত হয়, তখন আত্মকল্যাণ অপেক্ষা বৃহত্তর কল্যাণবোধ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন জ্বলে ওঠে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার নিষ্কলুষ প্রদীপশিখা।
স্বদেশপ্রেমিকের দেশ সেবার পথে বাধা অনেক। অত্যাচার সীমাহীন, কিন্তু পথের ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত তাদের দৃঢ় বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কাছে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ইতিহাসের পানে তাকালে এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত মেলে। পরদেশি কিংবা স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু কিংবা উদ্যত অস্ত্র তাদের নিবৃত্ত করতে পারে না, আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসও স্বদেশপ্রেমের গর্বে গর্বিত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের স্বদেশপ্রেমের প্রমাণ দেয়।
দেশপ্রেম জাতি ও দেশের জন্য গৌরবের বস্তু। কিন্তু অন্ধ দেশপ্রেম ধারণ করে ভয়ংকর রূপ। জাতিতে জাতিতে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য করে তোলে অন্ধ দেশপ্রেম। আমরা স্বদেশের জয়গান গাইতে গিয়ে যদি অপরের স্বদেশপ্রেমকে আহত করি, তবে সেই স্বদেশপ্রেম ডেকে আনে ভয়াবহ দ্বন্দ্ব-সংঘাত।
স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা তার বিপর্যয়েই প্রকাশ পায়; দুর্দিনেই তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। স্বদেশের পরাধীনতায়, স্বদেশের ওপর হামলায়, স্বদেশের মুখে কলঙ্কের কালিমা লেপনের সময় মানুষের ভেতর স্বদেশপ্রীতি মূর্ত হয়ে ওঠে। তখন জন্মভূমি কাতর নয়নে সন্তানের দিকে তাকায়, আর সন্তান জননীর বেদনায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। স্বদেশের দুঃখমোচনে সে তখন জীবন উৎসর্গ করে ধন্য হতে চায়। প্রবাস জীবনেও স্বদেশপ্রেম মূর্ত হয়ে ওঠে—জলাশয় বিচ্ছিন্ন মৎস্যের মতো। তখন জীর্ণ কুটিরই রানির মতো ঐশ্বর্য নিয়ে দেখা দেয় এভাবে—
‘আমার কুটিরখানি
সে যে আমার হূদয় রাণী।’
স্বদেশপ্রেম সব মহত্ত্বের উৎস, মনুষ্যত্ববোধের জাগরণকারী। এটি মানুষের ভেতরের সব সংকীর্ণতা দূর করে তাকে মহৎ হওয়ার দীক্ষা দেয়। এর স্পর্শে মানুষের ভেতরের সব পশুত্ববোধ বিদূরিত হয় এবং মানবকল্যাণে মানুষ নিজেকে উৎসর্গ করার দীক্ষা পায়। মূলত স্বদেশপ্রেম নামের পরশপাথরের স্পর্শেই মানুষ দুনিয়ায় স্মরণীয়, বরণীয় হয়। এ কারণে নিজের দেশ ধনী কি গরিব সে প্রশ্ন মানুষের কাছে অবান্তর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন—
‘জানি না তোর ধন রতন
আছে কিনা রাণীর মতন
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।’
খাঁটি দেশপ্রেমিকদের কাছে দেশের সবকিছু পরম পূতপবিত্র। তাদের কাছে দেশই একমাত্র আদর্শ। হাসিমুখে এরা জীবন দিতে পারে। এদের সাহস, শৌর্য আর দৃঢ়তা যুগে যুগে জাতিকে অনুপ্রেরণা জোগায়। জাতীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের অমানিশায় এরা ধ্রুবতারার মতো আলো বিচ্ছুরণ করে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, কিশোর ক্ষুদিরাম, তিতুমীর প্রমুখ দেশপ্রীতির জ্বলন্ত নিদর্শন। তা ছাড়া, ইতালির গেরিবল্ডি, রাশিয়ার লেনিন ও স্তালিন, চীনের মাও সেতুং, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভিয়েতনামের হো চি মিন প্রমুখ বিশ্বঅঙ্গনে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে নিজ নিজ মহিমায় ভাস্বর। বাঙালি জাতির দেশপ্রেমও বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। এ যেন মণি-মুক্তার চেয়েও শ্রেয়। যেমনটি বলেছেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত—
‘মিছা মণি-মুক্তা-হেম
স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাই আর।’
দেশপ্রেম শুধু কতগুলো প্রাণহীন শব্দের সমাহার নয়, নয় কোনো নিছক বিমূর্ত আদর্শ। যদি বৃহত্তর কল্যাণবোধ থাকে অসুন্দরের ছদ্মবেশে, তাহলে হূদয়ের কোন ঐশ্বর্য নিয়ে মানুষ মানুষ হবে না। স্বদেশপ্রীতির মধ্যেই মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধন। দেশপ্রেমিক ছাড়া দেশের উন্নতি অসম্ভব। আমরা সবাই যদি পরম সততার সঙ্গে দেশের প্রতি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করি, তবে দেশের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। স্বদেশপ্রেম শুধু বিমূর্ত একটি আদর্শই নয়, এটি স্বদেশকল্যাণের প্রদীপ্ত প্রত্যয়ও বটে।

Post a Comment