ছোট গল্প ( তরী )

তরী/ মো : সাইদুর রহমান/ ‘ তরী তুই কই যাচ ? হাঁঝ অইয়্যা গেছে , তাড়াতারি ঘরে আয়।’ এই ভাবে ডাকছিল তরীর মা। তরী সদা হাস্যজ্জল দশ বছর বয়সী এক কিশোরী বালিকা । গরীব বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। স্কুল থেকে ফিরে এসে ছাগল ছানা নিয়ে মাঠে খেলতে যায়। বাড়ির পাশেই চাষের জমি । ফসল উঠে যাওয়ায় সেটা এখন বা”চাদের  খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে কয়েকদিনের জন্য। সবার সাথে তরীও খেলছে । এদিকে মসজিদে আযান দিয়েছে। তরী ছাগল ছানা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। সারাদিন মহাজনের নৌকায় কাজ করে পরিশ্রান্ত সধু মিয়া বাড়িতে ফিরেই ‘ তরী মা এই দিকে আয় , দেখ তোর ল্যাইগা কি আনচি ?’ তরী : ও....মা ! বাবা আমার ল্যাইগা লাল ফিতা আনচ ? খুব সুন্দর তো । সধু মিয়া : তোর মারে বোলা , আমার অনেক ভোকে ধরছে। আমারে খাওন দিতে কঅ । তরী : মায়েতো গাঙের পারে গেছে , রান্দনের পানি আনতে । আমনে হাত-পা ধূইয়্যা আইয়্যেন , আমি আমনেরে ভাত দিতাছি। নদীর পার থেকে তরীর মা এসে  - ও তরী . . তোর বাপে আইচে ? তরী : হ..মা , হাত-পা ধূইতে গেছে । সধু মিয়া  ভাত খেয়ে ‘ তরীর মা , বাজারের যাওয়ার খলইটা দেও , বাজারে যাওন লাগবো তো । কিছু কি লাগবো ? আমারে কও ।’ তরীর মা : হ............. চাইল , ডাইল , আলু , নুন , তরকারি বেকই লাগবো। সধু মিয়া : হুন তরীর মা , আমগো মহাজন একটা বড় নৌকা আর গুলডি জাল ( বড় ইলিশ মাছ ধরার জাল ) নামাইবো । তহন আরো বেশি রুজি র্কতাহারমু। আমগো অভাব বেশি দিন থাকবো না । গাঙ্গে অহন বেশি মাছ আইছে । আইজ্যা পাঁচশো টেয়া রুজি অইছে । আঅনের সময় ফেরিওলার তন্ তরীর লেইগ্যা লাল ফিতা আনচি। মাইয়্যাডা বড় অইতাছে , একটা ভালা যায়গায় বিয়া দিতে পারলে ভালা অইত । তরীর মা : হেইডা কি আর অইব ? বেক লোকে জানে মাইয়্যাডা জারক ।  আমাগো বিয়ার সাত মাস পরেই তো মাইয়্যা অইচে ।  এলাকার মাইন্সে আমগরে এক ঘইরা কইরা রাখছে। আমরা ঠিকমত কেহইর লগে চলমিশ করতে হারিনা। তালুকদার মিয়ায় যদি তোমারে নৌকায় কাম না দিত , তাইলে আমরা চলতাম কেমনে ? সধু মিয়া : ঠিকই কইচ ! আমরা এমন কি অন্যায় করছি ? একজন আরেকজনেরে ভালবাসছি । যাই অউক , মাইয়্যাডাওে বিয়া দিতা হারলেই বাঁচি । তরীর মা : হ.... আল্লারে ডাক । তুমি এহন বাজারে যাও । তাড়াতাড়ি আইবা কিন্তু । পরের দিন নদী পাড়ে অনেক মানুষের ভীড় । তালুকদারের বড় নৌকা আজ প্রথম নদীতে নামবে । মসজিদ থেকে হুজুরেরা এসেছেন ।  নৌকায় মিলাদ হবে । সধু মিয়াও মাথায় টুপি পরে সবার মত  নৌকায় বসলেন । কিন্তু সেটা কিছু লোকের সইল না । হুজুর : এ....ই.. , তুমি মিয়া নৌকায় উটচ কেন ? নাম , নাম বলছি। তুমি আমগলোগে দোয়া করবা   না । নাইলে তোমার লেইগ্যা আমগো দোয়া আল্লা কবুল করব না । সবার উদ্দেশ্যে  হুজুর  - ‘ ও মিয়ারা শোন । - এই পাপীরে নৌকা থেইকা নামাও । ’ সধু মিয়া নিজেই নৌকা থেকে নেমে দুরে একটি গাছের গোড়ায় একা একা বসে রইলেন । মিলাদ ও দোয়া শেষে সবাইকে বাতাসা দেয়া হইল । কিন্তু সধূ মিয়াকে দেয়া হল না। যেই দোয়ার বাতাসা সধু মিয়া খাবে , সেই দোয়ার বাতাসা হুজুর খাবে না । হুজুর তালুকদারকে ডেকে বলে “ তালুকদার সাহেবরে আগেই বলছি , সধু মিয়ারে নৌকায় না নিতে । তারপর ও ছোট নৌকায় যখন তারে কাজে নিলেনই , আমি আর তেমন কিছু বললাম না । তবে এই বড় নৌকায় তারে কাজে নিয়েন না । তাইলে আপনার সব যাইব , নৌকাও যাইব , জালও যাইব । আমি সাবধান কইরা দিলাম ।   ও পাপী , ওরে নৌকায় নিও না । ” ইঞ্জিন চালিয়ে নৌকা মাছ ধরার জন্য নদীর দিকে চলে গেল । আর সধু মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি গেল । সন্ধ্যার পর তালুকদার মিয়া চুপি চুপি এসে সধুকে ডাকল । তালুকদার সাহেব : হুন সধু মিয়া , তোমারে নিয়া  পড়ছি বিপদে । সবার সামনে তোমারে নৌকায় কাম দিতে পারমুনা । লোকে আমারে ছি.....ছি.... করবো । তুমিতো বেকই জানো । এহন তোমারে যা কইতাছি , তা তুমি মন দিয়া হুন । তোমারে তো কেহই কামে লইব না । তাই , আমি কইতাছি তুমি দিনের বেলা আমার গরু গুলির দেখাশোনা কর । এতে , আমি তোমার সংসারের ভরণ-পোষন দিমু । আর যদি পার , একজনরে মিল কইরা, রাইতে আমার ছোট নৌকাডা লইয়া গাঙে যাইও। দুই-চাইর টেয়া জমাইতে পারলে তোমার ভবিষ্যৎ অইব । মাইয়্যাডা বড় অইতাছে , বিয়াতো দেওন লাগবো । এহন ভাইব্যা দেহ কী করবা ?     সধু মিয়া : চাচা , ভাইব্ব্যা দেহনের কাম নাই । আমনে যা কইছেন , আমি এইডাতেই রাজি । আমনের মতন আরেক জন লোক এই গেরামে নাই । আমনে একজন ভালা মানুষ। কিন্তু এই হুজুর আর মাতবর চাচাইতো আমার সর্বনাশ করলো । আমারে এক ঘইরা বানাইয়্যা এই গাঙের পারে হালাইয়্যা রাখলো । হেগো মনে এমন কি জিদ আছে , কে জানে ! তালুকদার সাহেব : হ .... আমি অহন যাই । তুমি কাল থেইকা কামে লাইগা যাও । আমি আইজই বাড়িতে বইলা দিমু । কাল থেইকা তুমি আমার গরু গুলোর দেখাশোনা করবা ।   পরদিন সকাল-সকাল সধু মিয়া ঘুম থেকে উঠে তালুকদার সাহেবের বাড়িতে গরুঘর পরিস্কার করে । গরুকে খৈল , ভূষি , পানি খাইয়্যে ঘাসের জন্য বের হয় । সধু মিয়া ঘাস পরিষ্কার করার জন্য নদীর পারে যায় ।  এদিকে তালুকদার সাহেবের বড় নৌকাটি ইঞ্জিন চালিয়ে মাঝ নদীতে মাছ ধরছে । সধু মিয়া অধির আগ্রহে টলমল চোখে তাকিয়ে থাকে । দিনের কাজকর্ম শেষ করে সধু মিয়া  সন্ধ্যার পর তালুকদার সাহেবের সেই ছোট নৌকাটির কাছে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে । কিন্তু তার সাথে কাজ করার মত কাউকেই পাচ্ছেনা । নিরুপায় হয়ে সধু মিয়া বাড়িতে ফিরে যায় । বাড়িতে স্ত্রী-মেয়ের সাথে এইসব বিষয় আলোচনা করে ।  তরী : বাবা ! আমি কি তোমার লগে রাইতের বেলা গাঙে যামু ? সধু মিয়া : না.... না , তোর লেহা-পড়া আছেনা । তাছাড়া , রাইতে গাঙে ডাকাত পড়ে । তুই তহন কি করবি ? তরী : আমি দিনে পরমু । আর ডাকাইতরা আমগো এই ছোড নৌকায় ডাহাতি করতে আইবনা । সধু মিয়া : ঠিক আছে , কাইল একবার দেহুম , তোরে লইয়্যা যাওন যায়নি । এহন ঘুমাইতে যা ।   পরদিন সকালে তরী স্কুলে যায় । স্কুল থেকে ফিরেই তরী মাকে ডাকে । তরী : মা , ও মা । বাবা আইয়্যেনা ? তরীর মা : তোর বাপে আইব হাঁঝে । তরী : আমি আজ রাইতে বাবার লগে গাঙে যামু । মা , আম্গরে দুগা খৈই-মুড়ি  আর মিডাই দিয়া   দিও ।  খেও হুালাইয়া আমরা বইয়্যা বইয়্যা খামু । তরীর মা : আইচ্ছা ঠিক আছে , এহন খাইতে আয় । সধু মিয়া দিনের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে । এদিকে তরী  বাবার সাথে নদীতে যাওয়ার জন্য অস্থির ।   তরী : মা , বাবা আইচে । আমরা ভাত খাইয়্যা  গাঙে যামু । খাওয়া-দাওয়ার পর , তরীর মা তাদেরকে খৈই-মুড়ি আর মিঠাই দিয়ে দেয় । নদীতে জাল ফেলে যেন বাপ-মেয়ে খেতে পারে । তরী আর তার বাবা নদীর দিকে চলে গেল । তরীর মা বাড়িতে বসে আল্লার কাছে দোয়া করতে লাগলো ।              তরী আর তার বাবা নদীতে জাল ফেলে  নৌকায় বসে খৈই-মুড়ি খাচ্ছে আর গল্প করছে । সধু মিয়া :  তোর নাম কেন্ তরী রাখছি , তুই জানস্ ? তরী : না , বাবা ! আমনে বলেন । সধু মিয়া : তুই হওয়ার পরপর আমি একদম কাম কাইজ পাইনা । অনেকদিন আমগো অনেক অভাব গেছে । এমন-অ দিন গেছে , আমরা না খাইয়্যা আছিলাম । শেষমেষ তালুকদার সাহেব আমারে ডাইকা তার এই ছোড তরীতে কাম দেয় ।  তহন থেইকা কাম কাইজ কইরা এই সংসার চালাই । এরলেইগ্যা তোর নাম রাখছি তরী । তরী : বাবা দেহেন , কী সুন্দর চাঁন উলছে আসমানে ! সধু মিয়া : আইজ যে পুর্ণিমা । আমরা গাঙে মাছ ধরতে আইছি দেইখ্যা চাঁন আমগরে হরি দিতাছে । তরী : বাবা , খেও টানবা না ? সধু মিয়া : হ, সময় অইছে ত- , তুই বৈডা ধর , আমি জাল টানি । তরী : দেকছেন বাবা ! নদীতে এহন মাছ আইছে । আমরা কতগুলি মাছ হাইছি । আইজ অনেক টেয়া বেচন যাইব । সধু মিয়া : একটু কষ্ট কইরা টেয়া জমাইতে হারলে , তোর লেইগ্যা গয়না গড়ামু । বাপ-মেয়ের এই গল্পের মধ্যে হটাৎ দূর থেকে লাইটের আলো এসে পড়লো এই নৌকায় । ইঞ্জিন চালিয়ে একটি বড় নৌকায় করে আট-দশ জন জলদস্যূ এসে ঘিরে ধরল তরী ও তার বাবাকে ।  তাদের হাতে ছিল দেশীয় অস্ত্র , ধারালো রাম-দা আর মুখ ছিল গামছা দিয়ে বাঁধা । একজন বলতে লাগলো -   “ এই তোদের কাছে কত টাকা আর মাছ আছে ? বাঁচতে চাচতো সব দিয়ে দে । নইলে তোদের বাপ-মেয়েরে আস্তা রাকমুনা । ” সধু মিয়া : আমনে মাতাব্বর চাচার ছেলে আজগর ভাই না ?! আমি আমনেগরে চিন্না পালাইছি । অমনি আজগর ডাকাত লাঠি তুলে সধু মিয়ার মাথায় আগাত করতে গেলে তরী বাবা বলে চিৎকার করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে , আঘাতটা তরীর মাথায় ঘিয়ে লাগে । ডাকাতের দল পালিয়ে যায় । এদিকে তরীর মাথা থেকে অনেক রক্ত ঝরছে । সধু মিয়া হাউ-মাউ করে চিৎকার করতে করতে তীরে এসে  পৌঁছল ।  সধু মিয়া ও তরীর মা কাঁদতে কাঁদতে তরী কে নিয়ে হাসপাতালে যায় । ততক্ষনে তরী অচেতন হয়ে গেছে । হাসপাতালের আবাসিক ডাক্তার এসে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয় । পরদিন সকাল না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাবে না । তরীর বাবা ও মা নামাজ পড়ে আল্লার কাছে দোয়া করে , তরীর সুস্থতার জন্য । হয়তো রাঙা প্রভাতে নতুন সুর্যোদয়ের সাথে নতুন এক জীবন নিয়ে তরী ভেসে বেড়াবে আমাদের মাঝে । কিন্তু তা আর হলো না । মস্তিষ্কে অনেক রক্তক্ষরণ হওয়ায় তরীর জ্ঞান ফিরা অনিশ্চিত । তরীর উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন । শহরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে হবে । সধু মিয়ার কাছে টাকা-পয়সা নেই । তাছাড়া তরীর জ্ঞান ফিরলে , তবেই বুঝা যাবে তার চিকিৎসা সর্ম্পকে। ডাক্তারের পরার্মশ নিয়ে তরীকে হাসপাতালেই রাখা হল । তরীর বাবা - মা  তরীকে ভালবাসায় আদর স্নেহে দিন-রাত সেবা করে যাচ্ছে । দুই মাস পর একদিন বিকেল বেলা হঠাৎ তরীর চোখ খুল্ল । একটু একটু করে  কথা বলার চেষ্টা করছে। এতদিন পরে তরীর বাবা-মার মুখে একটু হাঁসি দেখা গেল । তরীকে যত তাড়াতারি সম্ভব উন্নত চিকিৎসা দিতে হবে । এখন যে অনেক টাকার প্রয়োজন । যদিও তালুকদার সাহেব কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করে । কিন্তু এতটাকা কিভাবে জোগাবে , এই চিন্তায় তরীর বাবা-মার মুখে গ্লানির চিহ্ন । অনেক ভেবে চিন্তে সধু মিয়া ও তরীর মা সেই ছোট নৌকাটি নিয়ে নদীতে যায় মাছ ধরতে । সধু মিয়া : তুমি বৈডা ধর । আমি জাল পালাইতাছি ।   তরীর মা : আল্লার নামে মুখে লও । জাল পেলে দুইজন নদীর পানিতে অযু করে আল্লার কাছে দোয়া করতে লাগল।                                                                                                                               দোয়া শেষে -  সধু মিয়া : তরীর মা , খেও টানার সময় অইছে । তরীর মা : তুমি জাল টান , আমি বৈডা ধরি । সধু মিয়া জাল টানছে । তরীর মা : দেহ , আইজ অনেক মাছ উটতাছে । আল্লায় আমাগো দিগে মুক তুইল্লা চাইছে । সধু মিয়া : আইজ্জার মত এত মাছ কোনদিন আমার জালে উডে নাই । তরীর মা : আরো কয়েকটা খেও বাইতে অইব। সধু মিয়া : ঠিকই কইচ , তরীর মা । এহন আগে ঠিকমত বৈডা ধর । জাল তোলা শেষ হলে তরীর মা এই ছোট নৌকা টাকে সালাম করে চুমু খায় । এই নৌকাটাই তাদেরকে আজ কয়েক বছর ধরে আগলে রেখেছে । এই ছোট নৌকাটাইতো  তরী । তাদের মেয়ে তরীর মতই যেন আরেকটি জীবন্ত সন্তান । তাদের দুঃসময়ে এই নৌকাটাই  ছিল একমাত্র সম্ভল । আজ নৌকা ভর্তি মাছ । তরীর বাবা-মার চোখে আনন্দাশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে । হঠাৎ কালো মেঘে আকাশ চেয়ে আসছে । বিদুৎ চমকাচ্ছে । ঝড় উঠছে । তরীর বাবা-মা ছোট সেই তরী নিয়ে তীরের দিকে ধেয়ে আসছে । পানিতে পুঁতে রাখা বাঁশের ধাক্কায় তরীর নিছে ছিদ্র হয়ে গেছে । তরীতে পানি ঢুকে একাকার । অতপর , তীরে এসে তরী ডুবে গেল ।   র‌্যাপিড পিআর নিউজ/এস আর/ ২৮ আগস্ট

Post a Comment