খুব সম্ভবত বাংলাদেশের কোন মেইনস্ট্রিম নিউজ পেপারের কানে এখনো এই খবরটি পৌছাঁয়নি। এই নোটে আমি যে ছবি দুটো দিয়েছি, সেগুলোও খুব বেশী বাংলাদেশী দেখেন নি। কারন খবরটি একেবারেই টাটকা। খবরটি প্রকাশ হয়েছে ২৪ ঘন্টাও হয়নি, এবং তা অনলাইনের দুয়েকটা অপরিচিত-বিদেশী ম্যাগাজিনে। আমি আজ সকালেই প্রথম দেখলাম। তাই সঙ্গতকারনেই, ব্যাপকভাবে এর প্রচার এখনো শুরু হয়নি। অথচ খবরটা আমাদের জন্য জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে যত ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পদ্ধতি রয়েছে, মেট্রো রেইল, মতান্তরে মনো রেইল হচ্ছে তার ভেতর সবচাইতে আধুনিক (এবং এ কারনেই সবচাইতে ব্যয়বহুল) পদ্ধতি। তাই শুরু থেকেই মেট্রোরেইল নিয়ে আমরা অসম্ভব রকম আশাবাদী ও উল্লসিত ছিলাম। কিন্তু এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই গুঞ্জন চলছে। মাঝে দেখা দিয়েছিলো ব্যাপক অনিশ্চয়তা। কিন্তু এত সব গুঞ্জন আর অনিশ্চয়তার মাঝেই Dhaka Metro Rail Transit Authority (নতুন নাম Dhaka Mass Transit Company Ltd) সম্প্রতী একটা অভাবনীয় কাজ করে ফেলেছে। মেট্রো রেইলের নকশার জন্য তারা রীতিমতো একটা প্রতিযোগীতার আয়োজন করে। দেশের ভেতর নয়, সারা বিশ্বে। পৃথিবীর নামকরা সব আর্কি ফার্ম সেখানে ডিজাইন জমা দিয়েছিলো। সেই প্রতিযোগীতার ফলাফল গতকালই প্রকাশ করা হয়েছে। আমাদের মেট্রো রেইলের জন্য যে সব কোম্পানি ডিজাইন জমা দিয়েছে তাদের ভেতর থেকে সেরা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে স্বনামধম্য বিট্রিশ কোম্পানি ’জন ম্যাকআসলান + পার্টনারস’, সংক্ষেপে বলা হয় JMP। বাংলাদেশের পেশাদার আর্কিটেকচাররা হয়তো ইতিমধ্যেই জানেন যে, অবকাঠামোগত নকশা (Infrastructural Design) এর জগতে ম্যাকআসলান একটা আইকনিক নাম। বিট্রিশ এই কোম্পানিটি তাদের অভূতপূর্ব স্থাপত্য নকশার জন্য গত কয়েক দশক থেকেই বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। এই কোম্পানিটির বয়স ৬৪ বছর। নিজেদের দেশের ভেতর তারা সবচাইতে বেশী কাজ করলেও মধ্যপ্রাচ্য আর রাশিয়াতেও তাদের বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট রয়েছে। উল্লেখ্য, নয়া দিল্লীর ‘আনন্দ বিহার’ ট্রান্সপোর্ট হাব ও ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক ‘কিংস ক্রস’ পাতাল রেইল ষ্টেশনের নতুন নকশাটি তাদেরই করা। তাদের ওয়েব সাইটেই তাদের চোখ ধাঁধাঁনো সব ডিজাইন দেখতে পাওয়া যাবে। যেগুলো কোন ডেমো নয়, রীতিমতো চলমান ও সম্পন্ন হওয়া প্রজেক্টের ছবি। ম্যাকআসলান নিয়ে আমার স্বল্পকিছু ধারনা আগে থেকেই ছিলো তাই যখন আমাদের মেট্রো রেইলের প্রজেক্টে এর নাম শুনলাম, তখন প্রচন্ড খুশীতে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। যারা আর্কিটেকচার নিয়ে একটু হলেও জ্ঞান রাখেন, তারা হয়তো ছবি দুটি দেখেই বুঝবেন যে, এ নকশাতে বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতা ও পেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্ট। এবং একই সাথে একে পরিবেশবান্ধব করেও নকশা করা হয়েছে, যাতে করে ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং বায়ু ও শব্দ দূষন সামলাতে পারে। যদিও মূল ডিজাইনের অতি ক্ষুদ্র অংশ মিডিয়াতে প্রকাশ পেয়েছে, তবু ততটুকু দেখে শুরুতেই যে কারো মনে হবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নির্ভর কোন এক মুভির সেট। থ্রিডি এই ছবি দুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এর নকশা অত্যন্ত আধুনিক ও মনমুগ্ধকর। ডিজাইন দেখে মনে হবে উন্নত বিশ্বের কোন একটি স্থাপনা, কারন আমদের দেশে সরকারী স্থাপনা মানেই হচ্ছে দায়সারা গোছের, নিম্নমানের ক্ষ্যাত ডিজাইন। যদিও সম্প্রতী কিছু কিছু সরকারী স্থাপনা নজর কাড়ার মতো করে গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে।
উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মেট্রো রেইলের প্লাটফর্মে আমাদের দেশীয় পোষাক পড়ে কয়েকজন নারী হেটেঁ যাচ্ছেন। তাদের মাথার উপরে একটি সাইনবোর্ডে লেখাঃ প্লাটফর্ম নম্বর ২। তার নীচে ছোট্ট করে লেখা ’কারওয়ানবাজার’। মূল রেইল লাইনটির দু পাশে প্লাটফর্ম বরাবর নিরাপত্তার জন্য শক্ত গ্লাস দিয়ে মোড়া। (ধারনা করছি, ট্রেন থামলে ট্রেনের দরজার সামনের অংশটুকুর গ্লাস ম্যানুয়ালি খুলতে হবে)। এই পরিপাটি ও ঝকঝকে ছবিটি নিঃসেন্দেহে প্রচন্ডরকমের আশাজাগানিয়া। নিশ্চিতভাবেই আমরা দেশে এরকমটা আর কখনো দেখিনি।
পরের ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, মেট্রো ষ্টেশনে যাত্রীদের অনায়াস উঠানামা নিশ্চিত করতে একটা ছিমছাম অথচ সর্বাধুনিক দুটি এলিভেটর শ্যাফট মেট্রো লাইনের দু পাশে থেকে দুদিকে নেমে গেছে, যেগুলো স্টেশনটিকে মাটির সাথে সংযুক্ত করেছে। সিড়িঁতে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশীয় পোষাক সালোয়ার কামিজ পরিহিতা, ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেয়া রমনীদের। তার আশে পাশে শার্ট প্যান্ট বা সোয়েটার পরহিত পুরুষরাও রয়েছেন। মাথার উপরে মেট্রো রেইল ষ্টেশন, তার নীচ দিয়ে হাইওয়ে ধরে চলে যাচ্ছে বিলাসবহুল চেয়ার কোচ, প্রাইভেট কার ও ফুটপাথ দিয়ে পথচারী।
তবে এই ডিজাইনের সবচাইতে আকর্ষনীয় দিক হচ্ছে প্লাটফর্মের ছাদটি। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন-সুউচ্চ সে ছাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ধবধবে সাদা রংয়ের দুটি বিশেষ ধরনের জ্যামিতিক প্যাটার্নওয়ালা ধনুকাকৃতির খিলান দুদিক থেকে সরলরৈখিকভাবে একে অপরকে ভেদ করে চলে গেছে। তার মাঝে কয়েক জাগায় ট্রান্সপারেন্ট গ্লাস দেয়া যাতে করে সূর্যের আলো প্রবেশ করে উভয় পাশের প্লার্টফর্মকে আলোয় ভরিয়ে দিতে পারে। (ধারনা করছি, ছাদের এই অংশটুকুকে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রন করা যাবে। কারন দিনের সব সময় সব অংশে সমান সূর্যালোক পড়ে না।) গ্রানাইট পাথর আর মার্বেল পাথরের টাইলসের এই শামিয়ানাটার ভেতরকার এই গ্লাসের অংশটুকু মনে করিয়ে দিবে ইসলামিক শিল্প কলার আদলে নির্মিত টাইলসের কথা।
ম্যাকআসলানের ডাইরেক্টর হিরো আসো বলেন, ”ঢাকার মতো শহরের জন্য অতীব তাৎপর্যপূর্ণ এই অবকাঠামোগত পদ্ধতিটি গড়ে তুলতে পারার অনবদ্য সুযোগ লাভ করা করায় আমাদের কোম্পানি অত্যন্ত আনন্দিত। পরিবহনমন্ত্রী ওয়ায়দুল কাদের আমাদের নকশাকে স্ফিতবক্ষে অনুমোদন করেছেন। এটা আমাদের অত্যন্ত উত্তেজনাকর একটি সুযোগ যেটা এশিয়াতে আমাদের ক্রমবর্ধমান পোর্টফোলিও তৈরী করেছে, যেমনটা করেছে নয়া দিল্লীয় আনন্দ বিহার ট্রান্সপোর্ট হাব।”
আমি তার ইংরেজী বক্তব্যটিও তুলে দিলাম।
Hiro Aso, Director of Infrastructure at JMP stated:
“JMP is delighted to have won this major commission to design a significant new infrastructure system for Dhaka. Transport Cabinet Minister Mr Obaidul Qader has given the scheme his wholehearted approval – this is a very exciting opportunity for the practice and adds to our growing Asian infrastructure portfolio, including metro stations and the new Anand Vihar transport hub in New Delhi.”
ডিজাইনে সর্বমোট ১৬ টি স্টেশন রয়েছে। একটা নির্দিষ্ট থিমের আউট লুক বজায় রাখতে সবগুলো ষ্টেশনই একই ডিজাইন মেনে করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে একটি ট্রেন ডিপো (Depot)-এর ডিজাইনও তারা করে দিয়েছে। দিনশেষে যেখানে সবগুলো ট্রেন পরের দিন ব্যবহারের জন্য অথবা মেইনটেনেন্সের জন্য সংরক্ষন করা হবে, যেটাকে বাংলা আভিধানিক ভাষায় বলা হয় ’যানাগার’।
মেট্রোরেইল প্রকল্পের জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার বা ২ বিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড। বাংলাদেশী মুদ্রামানে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। এটি ঢাকা-উত্তর কে ঢাকা-দক্ষিনের সাথে মিলিত করবে। এই প্রকল্প শেষ হবার জন্য সময় বেধেঁ দেওয়া হয়েছে ২০২১ সাল। প্লাটফর্মগুলো ২০২২ সালের মধ্যেই পুরোপুরি ব্যবহার করা শুরু হবে। ধারনা করা হচ্ছে, মেট্রো রেইলের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৫ লাখ লোক তাদের বাসা থেকে শিক্ষা অথবা কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মাথার উপরেও একটা ষ্টেশন স্থাপন করা হবে।
নীচের ছবিতে ১৬ টি ষ্টেশনের লে আউট দেখানো হয়েছেঃ
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মেট্রো রেইলের রুট হচ্ছে উত্তরা থেকে পল্লবী হয়ে মিরপুর ১০ ও ১১, শ্যাওড়াপাড়া কাজীপাড়া হয়ে আগার গাঁও, বিজয়স্মরনী, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার থেকে টিএসটি পার হয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে চলে গিয়ে মতিঝিলে গিয়ে শেষ হয়েছে। এর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। নির্মান কাজের সুবিধার্থে পুরো প্রকল্পটিকে ৩ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাথকিমকভাবে মনোনীত হবার পর আগামী বছর থেকে ম্যাকআসলান নকশার চূড়ান্তকরণ কাজ শুরু করবে। কাজ শেষ হবার পর তারা দেশীয় আর্কি ফার্মগুলোর সাথে যৌথভাবে মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু করবে।
সব মিলিয়ে এ কথা হলফ করে বলা যায় যে, সবকিছু প্ল্যানমাফিক ঠিক ঠাকমতো চল্লে, অভূতপূর্ব ও অসামান্য হবে এর নির্মানশৈলী এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো এই স্থাপনাটিও হবে আমাদের জন্য অন্যতম এক জাতীয় গৌরব।
নোটে ব্যবহৃত প্রথম দুটি ছবির স্বত্বঃ © John McAslan & Partners, London, England.
তথ্যসূত্রঃ
জন ম্যাকআসলানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে তাদের প্রজেক্টের লিষ্টঃ http://www.mcaslan.co.uk/projects
(নকশার চূড়ান্ত কাজ শেষ হবার পর এবং Dhaka Mass Transit Company Ltd (DMTCL) এর সাথে অফিসিয়াল চুক্তি সম্পন্ন হবার পর এই লিষ্টে আমাদের মেট্রো রেইল প্রজেক্টও অন্তর্ভুক্ত হবে)
এই ফাকেঁ একটা ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করিঃ
সিডনীতে অনেক বছর আগে আমি একজন বসনিয়ান তরুন আরবান আর্কিটেকচারের সাথে কথা বলেছিলাম। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম কি করে কমানো যায়। উনি বলেছিলেন, ”এজন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টের বিকল্প নেই। মানুষ যত বেশী পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করবে, যানজট তত কম হবে “ তার মতে, প্রাইভেট ট্রানপোর্ট ইউজ করা ট্রাফিক জ্যামের সবচাইতে বড় কারন। এরপর বল্লাম, কি ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট? আন্ডার গ্রাউন্ড রেলের মতো? তিনি বল্লেন, “একদমই না। তোমাদের ঢাকার মাটি যেরকম, সেখানে আন্ডার গ্রাউন্ড রেল লাইন বানানো মোটেও সাসটেইনেবল হবে না। বানালেও কয়েক দিন পর উপরের মাটি ধ্বসে যেতে পারে। তোমাদের জন্য বেষ্ট সলিউশান হচ্ছে মনোরেল।” এই কথা তিনি আমাকে বলেছিলেন বাংলাদেশে মেট্রো রেইলের পরিকল্পনারও অনেক আগে। আর এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে, ২০২২ সালে এদেশের জনসংখ্যা আরো কয়েক মিলিয়ন বাড়বে। সুতরাং, আগামী ১ দশক পর হয়তো এটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত রুট হবে।
লেখাটি সংগৃহীত
Post a Comment